অপরাধ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি সর্বশেষ

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ: বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ চলে যেতো ভারতে

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ: বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ চলে যেতো ভারতে

১৯৭৪ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। এ বছর দেশজুড়ে নেমে আসে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। হাজার হাজার মানুষ খাদ্যের অভাবে মৃত্যুবরণ করে। শহর ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে হাহাকার। এই দুর্ভিক্ষ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণেই ঘটেনি—এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং সীমান্ত অস্থিরতাসহ একাধিক কারণ। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় ছিল, আন্তর্জাতিক সাহায্য ও ত্রাণ যথাযথভাবে দেশের দুস্থ মানুষের কাছে না পৌঁছে পাশ্ববর্তী দেশে চলে যাওয়া।

দুর্ভিক্ষের পটভূমি

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ নতুন রাষ্ট্র হিসেবে গঠনমূলক কাজ শুরু করলেও, প্রশাসনিক অস্থিরতা, দুর্বল অবকাঠামো, দুর্নীতি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অভাব তখনো প্রকট। ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যা ও অকাল বৃষ্টির কারণে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এই অবস্থায় খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করে। সরকারের পক্ষে দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

আন্তর্জাতিক সাহায্য ও ত্রাণ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে বাংলাদেশে খাদ্যসহ নানা ধরণের সাহায্য আসতে থাকে। এই ত্রাণসামগ্রী মূলত দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু ব্যক্তি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে অনেক ত্রাণসামগ্রী সঠিক জায়গায় না পৌঁছে সীমান্ত পথে ভারতে পাচার হয়ে যেতো।

অনেক সময় সীমান্ত এলাকার অসাধু ব্যবসায়ী চক্র এবং কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে এই ত্রাণ ভারতে পাচার হতো। পণ্যবাহী ট্রাক বা নৌপথে চাল, গম, দুধ ও ওষুধ—সবকিছুই সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যেত। এই পাচারের ফলে দেশের ভেতরে চরম খাদ্যাভাব থেকে যায়, এবং দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হতে থাকে।

সরকারের প্রতিক্রিয়া

সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেও প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তদন্তে এই ত্রাণ পাচারের তথ্য উঠে আসে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ হয়নি।

দুর্ভিক্ষের মানবিক বিপর্যয়

এ দুর্ভিক্ষে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন তার নির্ভুল সংখ্যা আজও জানা যায় না, তবে অনুমান করা হয় হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন। রাস্তায়, রেলস্টেশনে, হাটে-বাজারে অসংখ্য মানুষ খাদ্যের জন্য ভিক্ষা করতেন, আবার অনেকে খাদ্য না পেয়ে না খেয়েই মারা যেতেন।

উপসংহার

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল বাংলাদেশের জন্য এক বড় শিক্ষা। ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, খাদ্য সংরক্ষণ ও বণ্টন ব্যবস্থায় উন্নয়ন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ—এই সবকিছুর অভাব ছিল তখন। আর সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় ছিল, যেসব ত্রাণ বিদেশ থেকে এসেছে মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্য, তা অপরিকল্পিতভাবে ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের বাইরে চলে যাওয়া। এই ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শুধু সাহায্য নয়, সাহায্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।