তখন রোজারিও থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরের বুয়েন্স আয়ার্সে যাওয়ায় তাঁর জন্য লম্বা এক পথ। বছর তেরোর সেই লাজুক ছেলেটিকেই কিনা পাড়ি দিল ইউরোপে। স্পেনের বার্সেলোনা তখন তাঁর জন্য ভিন্ন এক জগৎ। স্প্যানিশ বলতে পারতেন, তবে বার্সেলোনায় গিয়ে ফুটবলের ভাষাতেই তিনি চিনিয়ে ছিলেন নিজেকে। শুরু করেছিলেন নতুন এক জীবনের অন্বেষণ।
এর পর প্রায় দুই যুগ ধরে শুধুই ব্যস্ততা। বার্সেলোনা থেকে প্যারিস হয়ে এখন কেয়ার অব মায়ামি। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কিছুটা বোধ হয় ক্লান্ত লিওনেল মেসি! বছর আটত্রিশে দাঁড়িয়ে তাই ‘শেষের’ নিমন্ত্রণ দিয়েছেন তিনি ভক্তকুল আর আপনজনদের। ঘরের মাঠ বুয়েন্স আয়ার্সে শেষবারের মতো আর্জেন্টিনার হয়ে খেলতে নামছেন তিনি। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে এই ম্যাচটি আর্জেন্টিনার জন্য নেহাতই নিয়ম রক্ষার। কারণ, এরই মধ্যে বিশ্বকাপের টিকিট তাদের পকেটে।
কিন্তু মেসি যখন তাঁর ‘বিশেষ ম্যাচ’ বলে পরিবারের সবাইকে গ্যালারিতে নিয়ে আসছেন, তখন ভক্তকুলইবা কেন বাইরে থাকবেন। ৮৫ হাজার গ্যালারির স্তাদিও মনুমেন্তাল তাই মেসির বিদায় অনুষ্ঠান স্মরণীয় করে রাখতে বেশ কিছু আয়োজন করে রাখছে। মেসির নিমন্ত্রণে টেলিভিশন দর্শকরাইবা বাদ যাবেন কেন! তবে দুর্ভাগ্য বাংলাদেশি টেলিভিশন দর্শকদের জন্য। শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় শুরু হতে যাওয়া ম্যাচটি বাংলাদেশ থেকে কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা যাবে না। সার্চ দিতে হবে কিছু ওয়েবসাইট ও অ্যাপসে।
১৯৯৭ সালে বুয়েন্স আয়ার্সের এই মাঠ থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। বোকা জুনিয়র্সের হয়ে রিভার প্লেটের বিপক্ষে পেশাদার ফুটবলের শেষ ম্যাচটি খেলেছিলেন ম্যারাডোনা। ২৫ অক্টোবর সেই বিশেষ ম্যাচটি ২-১ জিতে অবসর ঘোষণা দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। মেসি অবশ্য ‘অবসর’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তবে কদিন আগে তিনি নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঘরের মাঠে এটিই আর্জেন্টিনার শেষ ম্যাচ, সুতরাং তাঁর জন্যও বিশেষ কিছু।
ইকুয়েডরে গিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর পরের ম্যাচটিতেও হয়তো খেলবেন না তিনি। ‘আমার জন্য এটা হবে খুব খুব বিশেষ ম্যাচ। কারণ, বাছাই পর্বে (ঘরের মাঠে) এটাই শেষ ম্যাচ। আমি জানি না, এর পর (আর্জেন্টিনায়) কোনো প্রীতি ম্যাচ হবে কিনা। তাই আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী, সন্তান, ভাই, বাবা-মা ও স্ত্রীর পুরো পরিবার সেখানে থাকবে। আমরা এভাবেই উপভোগ করতে চাই। তারপর কী হবে জানি না।’
মেসির এ বক্তব্যের পর দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কনমেবল আর দেরি করেনি, সংস্থাটির এক্স হ্যান্ডলে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের জার্সি পরা মেসির একটি ছবি পোস্ট করা হয়। ক্যাপশনটি ইংরেজি করলে দাঁড়ায়, ‘হেয়ার কামস দ্য লাস্ট ডান্স’। অর্থাৎ, জাতীয় দলের জার্সিতে ঘরের মাঠে মেসির শেষ ম্যাচ সমাগত।
আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এএফএ) প্রেসিডেন্ট ক্লদিও তাপিয়া অবশ্য চান, ২০২৬ বিশ্বকাপের পরও যেন মেসি খেলা চালিয়ে যান। ৪০ বছর বয়সী ক্রোয়াট তারকা লুকা মডরিচের উদাহরণ দিয়েছেন তিনি। সে যাই হোক, আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জনে নেমে পড়েছে। তারা এই ম্যাচের টিকিটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে সস্তা টিকিটের দাম ১০০ ডলার ও দামি টিকিট কিনতে হলে গুনতে হচ্ছে ৫০০ ডলার।
২০০৫ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে সিনিয়র দলে অভিষেকের পর এ পর্যন্ত মোট ১৯৩ ম্যাচ খেলে সর্বাধিক ১১২ গোল করেছেন মেসি। যার মধ্যে দেশের মাটিতেই খেলেছেন ৯৬টি ম্যাচ। অনেক অনেক স্মৃতি জড়িয়ে তাঁর আপন গ্যালারির সামনে। স্তাদিও মনুমেন্তালেই এ পর্যন্ত ২৭টি ম্যাচ খেলেতে নেমেছেন, গোলও করেছেন ১৭টি।
যদিও ম্যাচটিকে মেসির ঘরের মাঠে ‘শেষ’ বলতে মেনে নিতে চাচ্ছেন না অনেকেই। ‘আমি মনে করি না এটাই তার ঘরের মাঠে শেষ ম্যাচ। তাকে আগে খেলতে দিন, তারপর না হয় চিন্তা করবে অবসরের।’
আর্জেন্টিনার সাবেক গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আরমানির বক্তব্যটা এমন, এত সহজে মেসিকে ছাড়বে না তারা। আর্জেন্টাইন ফুটবল সংস্থার এক কর্মকর্তার ইঙ্গিত, ভবিষ্যতে কোনো প্রীতি ম্যাচ দিয়ে এই মাঠ থেকেই হয়তো মেসিকে অবসর সংবর্ধনা দেওয়া হবে। তবে সেটা এখনই না, মডরিচ যদি চল্লিশেও পুরো ফর্মে দেশের হয়ে খেলতে পারেন, তাহলে মেসি কেন না– প্রশ্নটা আর্জেন্টিনা ফুটবল সংস্থার প্রধান তাপিয়া নিজেই উস্কে দিয়েছেন।
আর্জেন্টিনার সম্ভাব্য একাদশ : এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, মোলিনা, রোমেরো, ওতামেন্ডি, ট্যাগলেফিগো, ডি পল, পারদেস, ম্যাক অ্যালিস্টার, আলমাডা, মেসি, আলভারেজ/লাওতারো।