ডিএসসিসি কাজ করেন ‘টেন্ডল’, ঘুরে বেড়ান কর্মকর্তা - Prothom Eye
Our website is currently under construction. We’ll be back soon with the latest news and updates. Thank you for your patience.

ডিএসসিসি কাজ করেন ‘টেন্ডল’, ঘুরে বেড়ান কর্মকর্তা

লেখক: প্রতিবেদক ঢাকা
প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৫

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ |

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) লাইসেন্স ও বিজ্ঞাপন সুপারভাইজার বেলায়েত হোসেন বাবু বংশাল, কোতোয়ালি ও সূত্রাপুর এলাকার (অঞ্চল-৪) দায়িত্বে আছেন। তবে কর্মচারী ইউনিয়নের একাংশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত নিজে কাজ করেন না। তাঁর হয়ে কাজ করেন বহিরাগত শাহ আলম, অনীক ও জনি। বাবুর কক্ষে তাদের জন্য পৃথক চেয়ার, টেবিল ও কম্পিউটার আছে। শাহ আলম ও অনীক কাগজপত্র যাচাই-বাছাইসহ বিভিন্ন কাজ করেন। জনি কম্পিউটারে করপোরেশনের সার্ভারে ঢুকে লাইসেন্স ও বিজ্ঞাপন-সংক্রান্ত কাজ করেন।

শুধু বেলায়েত নন, অন্য অনেক লাইসেন্স সুপারভাইজারও বহিরাগতদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। নগর ভবনে এই বহিরাগতরা ‘টেন্ডল’ বলে পরিচিত। তাদের হাত অনেক দীর্ঘ। নগর ভবনে নাগরিক সেবায় তারাই সর্বেসর্বা।

সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের বোঝাপড়া, জরুরি ফাইলপত্র খুঁজে বের করা, যাচাই-বাছাই, কম্পিউটারে অনলাইন সার্ভারে ডেটা ইনপুট করেন তারাই। গুরুত্বপূর্ণ নথি বিভাগীয় প্রধান, সচিব, প্রধান নির্বাহী এবং প্রশাসকের দপ্তরে আনা-নেওয়ার কাজও করেন তারা। তবে টেন্ডলদের কাজে এবার বিপাকে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের শপথ পড়ানোর দাবিতে গত মে ও জুন মাসে ৪৩ দিন আন্দোলন চলাকালে নগর ভবন তালাবদ্ধ ছিল। আঞ্চলিক অফিসেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করেননি। কিন্তু এই সময়ে করপোরেশন থেকে মোট ৮৮২টি নতুন ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু হয়েছে। নবায়ন হয়েছে কয়েক হাজার।

নিয়ম অনুযায়ী, অনলাইনে আবেদনের পর কর কর্মকর্তা এ লাইসেন্স সুপারভাইজারদের যাচাইয়ের পর ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করার কথা। এ-সংক্রান্ত কাজের আইডি ও পাসওয়ার্ড শুধু তাদেরই জানা থাকার কথা। তবে তারা লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের হয়ে টেন্ডলরাই আইডি-পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নের সব কাজ করেন। এমনকি এক অঞ্চলের লাইসেন্স সুপারভাইজারের আইডি-পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে আরেক অঞ্চলের লাইসেন্স দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ট্রেড লাইসেন্সে কর কর্মকর্তা ও সুপারভাইজারদের স্ক্যান করা স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। লাইসেন্স ইস্যুতে টেন্ডলরা পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

অঞ্চল-৪-এর লাইসেন্স সুপারভাইজার নাজমুল হোসেন মানিকের হয়ে কাজ করেন রফিক ও আবু নাসের। মোস্তফা নুরুদ্দীন সোহেলের হয়ে কাজ করেন তাঁর ছেলে। সুপারভাইজার মিরোজ নকিবের হয়ে কাজ করেন স্বপন। এ ছাড়া অঞ্চল-১-এর উপকর কর্মকর্তা আহম্মদের টেন্ডল তাঁর ভাগনে শামসু, লাইসেন্স সুপারভাইজার মাসুদুজ্জামানের টেন্ডল রানা ও আতিক, সুপারভাইজার ওয়াহিদের টেন্ডল জহির ও মাসুম, সুপারভাইজার নুরুজ্জামানের টেন্ডল চঞ্চল। এ ছাড়া লাইসেন্স সুপারভাইজার রোমেনা পারভীন, রেশমা আক্তার, সাইফুল ইসলাম, নাসির শিকদার, রুহুল আমিন গাজী, অঞ্চল ৫-এর উপকর কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম, কার্তিক চন্দ্র মজুমদার, রাজস্ব কর্মকর্তা মোবারক হোসেন, বিকাশ চন্দ্র পাল, দেলোয়ার হোসেন, আওলাদ হোসেন, ওমর ফারুক, শনয় কুমার পাল, হিসাব সহকারী হাসিনুর বেগম ও লাইসেন্স সুপারভাইজার সাদ্দাম হোসেনের দুয়েকজন করে টেন্ডল আছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে না গেলে টেন্ডলরাই দায়িত্ব পালন করেন।

অঞ্চল ৪-এর লাইসেন্স সুপারভাইজার নাজমুল হোসেন মানিকের টেন্ডল রফিক সমকালকে বলেন, ‘আমরা দুজন আছি। আরেকজন কম্পিউটারে কাজ করে, আমি কাগজপত্রের। করপোরেশনের বাইরে থেকে বিভিন্ন লোকের ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু আর নবায়নের কাজ এনে করে দিই। সেখান থেকে যা আসে, সেটাই আমাদের আয়। আলাদা করে বেতন দেওয়া হয় না।’

অঞ্চল ৪-এর লাইসেন্স ও বিজ্ঞাপন সুপারভাইজার বেলায়েত হোসেন বাবুর টেন্ডল শাহ আলম সমকালকে বলেন, ‘আমি বাবু ভাইয়ের হয়ে কাজ করি। সাথে অনিক আর জনি আছে। তবে জনি ডেইলি বেসিস। আমাদের বেতন করপোরেশন থেকে নয়, বাবু ভাই দিয়ে থাকে।’

অঞ্চল ৪-এর দপ্তরে গিয়ে বেলায়েত হোসেনকে এক দিনও পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে কল দিয়েও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চারটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে গেলেই দেখা যায়, লাইসেন্স সুপারভাইজারের কক্ষে ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য অনেকেই ভিড় করেন। প্রতি কক্ষেই চার-পাঁচটি করে চেয়ারে বসে টেন্ডলরা কাজ করছেন।

ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, ইশরাকের আন্দোলন চলাকালে অঞ্চল-১ (ধানমন্ডি-সেগুনবাগিচা) থেকে ৯২টি, অঞ্চল-২ (খিলগাঁও) থেকে ৩২৫, অঞ্চল-৩ (লালবাগ-হাজারীবাগ) থেকে ৭৯, অঞ্চল-৪ (কোতোয়ালি-বংশাল) থেকে ১৩৬, অঞ্চল-৫ (সায়েদাবাদ) থেকে ১২১, অঞ্চল-৬ (ডেমরা) থেকে আটটি, অঞ্চল-৭ (মান্ডা-নন্দীপাড়া) থেকে ১৪, অঞ্চল-৮ (সারুলিয়া) থেকে ২২, অঞ্চল-৯ (মাতুয়াইল-কাজলা) থেকে ৬৫, অঞ্চল-১০ (দনিয়া-শ্যামপুর) থেকে ২০টি ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এর মধ্যে অঞ্চল ২-এর রেন্ট অ্যাসিস্টান্ট মো. ইফরাত হোসেনের আইডি থেকে সর্বোচ্চ ১৬৮টি ও অঞ্চল ৩-এর লাইসেন্স সুপারভাইজার জহিরুল ইসলামের আইডি থেকে ১০৮টি লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। অঞ্চল ২-এর কর কর্মকর্তার কাছে এই অনিয়ম ধরা পড়লে আইটি বিভাগ অভ্যন্তরীণ তদন্ত করে। তদন্তে এই জালিয়াতির প্রমাণ মেলার পর প্রশাসক শাহজাহান মিয়ার কাছে ইফরাত ও জহিরুল দুই টেন্ডলকে আইডি-পাসওয়ার্ড দেওয়ার কথা স্বীকার করেন।

অঞ্চল ২-এর কর কর্মকর্তা শাহজাহান মিয়া সমকালকে বলেন, ‘ইশরাক হোসেন সমর্থকদের আন্দোলনের সময় নগর ভবনের সঙ্গে এই কার্যালয়টিও বন্ধ ছিল। আমি কোনো ট্রেড লাইসেন্সে স্বাক্ষর করিনি। অনলাইন থেকে স্বাক্ষর নিয়ে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এটি কীভাবে হয়েছে সেটি উদঘাটন এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে করপোরেশনকে জানানো হয়েছে।’

অঞ্চল ৫-এর কর কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আন্দোলনের সময় কোনো ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু হয়নি। সে সময় করপোরেশন কার্যত বন্ধ ছিল।’ ডিএসসিসির সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. আবু তৈয়ব রোকন বলেন, ‘লাইসেন্স সুপারভাইজারদের একবারই আইডি পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়। তাদের বিভিন্ন অঞ্চলে বদলি করা হলেও বারবার করপোরেশনের পক্ষে থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয় যাতে নিজেদের আইডি-পাসওয়ার্ড অন্য কাউকে না দেন। এ জন্য কিছুদিন পরপর আইডি-পাসওয়ার্ড পরিবর্তনের নির্দেশনাও আছে। এক অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যেন অন্য অঞ্চলের লাইসেন্স ইস্যু না করেন, সেটিও তাদের বারবার বলা হয়েছে।’

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘আমাদের কিছু ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু হয়ে গেছে। এ নিয়ে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা আমাদের জানিয়েছেন। এটি সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান করছে কিনা, সেটাও জানার প্রয়োজন আছে। এটি কীভাবে হলো, কারা জড়িত, সেটি বের করার জন্য করপোরেশনের বাইরের একটি তৃতীয় পক্ষের দ্বারা তদন্ত হচ্ছে। কর্মকর্তাদের ভাড়ায় খাটা টেন্ডল সম্পর্কে জানা নেই। এমনটি যেন না ঘটে, তাই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে আবার বসা হবে।’