মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমের দুই ধরনের ভূমিকার কারণে একে ‘দ্বিধার তলোয়ার’ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু কথায় আছে, ‘তরবারি তার খাপকে কাটে না’। তার মানে মানবদেহে এমন একটা ব্যবস্থা আছে, যা ইমিউন সিস্টেমের উপকারী এবং অপকারী ভূমিকাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কে বা কারা করে, কীভাবে করে তা আবিষ্কার করে ২০২৫ সালে ফিজিওলজি বা মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার জয় করে নিয়েছেন তিন বিজ্ঞানী– যুক্তরাষ্ট্রের মেরি ব্রুনকো ও ফ্রেড র্যামসডেল এবং জাপানের শিমন সাকাগুচি।
নোবেল কমিটির বক্তব্য
নোবেল কমিটি বক্তব্যে বলেছে, দেহে আক্রমণ করার চেষ্টা করে এমন হাজার হাজার জীবাণু থেকে প্রতিনিয়ত আমাদের রক্ষা করছে ইমিউন সিস্টেম। এসব জীবাণুর আলাদা আলাদা চেহারা রয়েছে; কিন্তু এদের ছদ্মবেশ ধারণ করার ক্ষমতাও আছে। এরা এমন ছদ্মবেশ ধারণ করে যে এদের চেহারা মানবদেহের কোষের সঙ্গে মিলে যায়। তাহলে ইমিউন সিস্টেম কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে কাদের আক্রমণ করতে হবে, আর কাদের রক্ষা করতে হবে? কেনই-বা ইমিউন সিস্টেম আমাদের দেহকে ঘন ঘন আক্রমণ করে না?
গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করতেন যে তারা প্রশ্নগুলোর উত্তর জানেন: ইমিউন সিস্টেমের কোষগুলো ‘কেন্দ্রীয় রোগ প্রতিরোধ সহনশীলতা’ নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিপক্ব হয়। কিন্তু তারা যা ধারণা করেছিলেন, আমাদের ইমিউন সিস্টেম তার চেয়েও জটিল। যে যুগান্তকারী মৌলিক ধারণা আবিষ্কারের জন্য ঐ বিজ্ঞানীত্রয়কে পুরস্কৃত করা হয়েছে, তা ‘প্রান্তীয় রোগ প্রতিরোধ সহনশীলতা’ সম্পর্কিত, যা ইমিউন সিস্টেমকে শরীরের ক্ষতি করতে বাধা প্রদান করে। নোবেল বিজয়ীরা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সুরক্ষাপ্রহরী ‘নিয়ন্ত্রক টি-কোষ’ চিহ্নিত করেছেন, যা রোগ প্রতিরোধের কোষগুলোকে আমাদের নিজের শরীর ধ্বংস করা থেকে বিরত রাখে। নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান ওলে কাম্পে বলেন, ‘আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে এবং কেন আমরা সবাই গুরুতর অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হই না, সে সম্পর্কে আমাদের বোঝার জন্য তাদের আবিষ্কারগুলো নির্ণায়ক।’
ইমিউন সিস্টেমের গঠন, কর্মস্থল ও কর্মপদ্ধতি
ইমিউন সিস্টেম হলো বিভিন্ন কোষ, টিস্যু এবং অঙ্গের একটি জটিল নেটওয়ার্ক। প্রাথমিকভাবে এর কোষীয় উপাদান শ্বেত রক্তকণিকা। মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখা যায় কয়েক প্রকার শ্বেত রক্তকণিকার সাইটোপ্লাজম দানাদার (গ্রানুলোসাইট), আবার কয়েক প্রকারের অদানাদার (অ্যাগ্রানুলোসাইট)। গ্রানুলোসাইট তিন রকমের– নিউট্রোফিল, ইওসিনোফিল, বেসোফিল এবং অ্যাগ্রানুলোসাইট দুই রকমের: লিম্ফোসাইট এবং মনোসাইট। নিউট্রোফিল সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়, যা ব্যাকটেরিয়াকে গ্রাস এবং ধ্বংস করার জন্য প্রথম প্রতিক্রিয়াকারী হিসেবে কাজ করে। ইওসিনোফিল পরজীবীর বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং অ্যালার্জিতে জড়িত থাকে, অন্যদিকে ব্যাসোফিল প্রদাহ বৃদ্ধির জন্য হিস্টামিন নিঃসরণ করে। মনোসাইট টিস্যুতে ম্যাক্রোফেজে পরিণত হয়, যা শক্তিশালী ‘বড় ভক্ষক’, যা রোগজীবাণু এবং মৃত কোষ পরিষ্কার করে।
নোবেল বিজয়ীদের আবিষ্কার
সেটা বুঝতে টি-সেলে মনোনিবেশ করলেই যথেষ্ট হবে। ১৯৯০-এর দশকে টি-সেল সম্বন্ধে কী ধারণা ছিল তা দেখে নেওয়া যাক। টি-সেল দুই ধরনের–
সহায়ক টি-সেল: ক্রমাগত শরীরে টহল দেয়। যদি তারা কোনো আক্রমণকারী জীবাণু আবিষ্কার করে, তবে তারা ইমিউন সিস্টেমের অন্য কোষগুলোকে সতর্ক করে, যারা তখন জীবাণুটিকে আক্রমণ করে।
ঘাতক টি-সেল: ভাইরাস বা অন্যান্য রোগজীবাণু দ্বারা সংক্রমিত কোষগুলোকে নির্মূল করে ফেলে। তারা টিউমার কোষকেও আক্রমণ করতে পারে।
একজন গবেষক স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে থাকেন। তাঁর নাম শিমন সাকাগুচি এবং তিনি জাপানের নাগোয়ায় ‘আইচি ক্যান্সার সেন্টার রিসার্চ ইনস্টিটিউটে’ কাজ করতেন।
সাকাগুচির বিশ্বাস ও ইমিউন সিস্টেম
সাকাগুচির সহকর্মীরা আগেই টি-সেলের বিকাশে থাইমাসের ভূমিকা বোঝার জন্য নবজাতক ইঁদুর থেকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এই অঙ্গটি অপসারণ করেছিলেন। তারা অনুমান করেছিলেন যে ইঁদুরগুলোতে কম টি-সেল তৈরি হবে এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হবে। দেখা গেল, যদি ইঁদুরের জন্মের তিন দিন পরে অপারেশন করা হয়, তাহলে ইমিউন সিস্টেম অতিরিক্ত গতিতে চলে যায় এবং উত্তেজিত হয়ে পড়ে, যার ফলে ইঁদুরগুলো বিভিন্ন ধরনের অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হয়।
ঘটনাটি ভালোভাবে বোঝার জন্য ১৯৮০-র দশকের শুরুতে সাকাগুচি জিনগতভাবে অভিন্ন ইঁদুরের মধ্যে পরিপক্ব হয়েছে এমন টি-সেলগুলো বের করে এনে সেগুলো থাইমাসবিহীন ইঁদুরের দেহে ঢুকিয়ে দেন। আকর্ষণীয় ফলাফল পাওয়া যায়। এমন ধরনের টি-সেল পাওয়া গেছে বলে মনে হয়েছিল, যা ইঁদুরকে অটোইমিউন রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে।
এটি এবং অন্যান্য অনুরূপ ফল সাকাগুচিকে বিশ্বাস করিয়েছিল যে ইমিউন সিস্টেমে অবশ্যই এমন ধরনের নিরাপত্তারক্ষী রয়েছে, যা অন্যান্য টি-সেলকে শান্ত করে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটি কোন ধরনের সেল?
আবিষ্কারের উপযোগিতা
‘নিয়ন্ত্রক (রেগুলেটরি) টি-সেল’ আবিষ্কার নতুন চিকিৎসার সূচনা করেছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় গবেষকরা টিউমারের চারপাশে এই কোষগুলোর প্রতিরক্ষামূলক ‘প্রাচীর’ ভেঙে ফেলছেন যাতে ইমিউন সিস্টেম তাদের আক্রমণ করতে পারে। বিপরীতে, অটোইমিউন রোগ এবং ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে এমন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে যেন রেগুলেটরি টি-সেলের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে রয়েছে রোগীদের ইন্টারলিউকিন-২ দেওয়া, যাতে এই কোষগুলো বৃদ্ধি পায়, অথবা রোগীর নিজস্ব রেগুলেটরি টি-সেলকে ‘ঠিকানা’ দিয়ে বিচ্ছিন্ন করা এবং এমনকি সংশোধন করা যাতে তারা নির্দিষ্ট অঙ্গগুলো রক্ষা করতে পারে। এই চিকিৎসাগুলোর বেশ কয়েকটি এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্রুনকো, র্যামসডেল এবং সাকাগুচির বিপ্লবী আবিষ্কার মানবজাতির জন্য অশেষ কল্যাণ বয়ে এনেছে।
দোস্ত যেন দুশমন হয়ে না যায়/ বেড়া যেন ক্ষেত না খেয়ে ফেলে
স্কটিশ সাহিত্যিক রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ‘স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ডক্টর হেনরি জেকিল বিশ্বাস করেন যে প্রতিটি মানুষের দ্বৈত প্রকৃতি থাকে– একটি সম্মানজনক এবং একটি মন্দ। তিনি এই দুটি অংশকে আলাদা করার উদ্দেশ্যে একটি ওষুধ তৈরি করেন, যার ফলে তার সৎ সত্তা তার নিজের শরীরেই থাকে এবং তার অন্ধকার আবেগগুলো একটি নতুন রূপে পরিশুদ্ধ করা হয়। এটি সফল হয়, কিন্তু একটি ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে; তিনি শারীরিকভাবে নীচ এবং পাশবিক মিস্টার অ্যাডওয়ার্ড হাইডে রূপান্তরিত হন। এক পর্যায়ে দুশ্চরিত্র হাইড সচ্চরিত্র জেকিলের ওপর কর্তৃত্ব করতে শুরু করে। মানবদেহের ইমিউন সিস্টেম অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থারও বিপরীতমুখী দুটি সত্তা বিদ্যমান। নোবেল পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত মহান আবিষ্কারটি এই সত্যই প্রকাশ করে যে দ্বন্দ্বপূর্ণ এই সম্পর্কের মধ্যে বিজ্ঞ কূটনীতিক হিসেবে কাজ করে রেগুলেটরি টি-সেল, তারাই ক্রমাগত মধ্যস্থতা করে চলে– দোস্ত যেন দুশমন হয়ে না যায়। ফক্সপিথ্রির মতো জিন দ্বারা পরিচালিত এই জটিল ভারসাম্য হলো গৃহযুদ্ধের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সুরক্ষা।
এই কূটনীতিকরা যেন স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারে সেজন্য আমাদের কী করণীয়? ঘুরেফিরে সংক্ষেপে উত্তর একটাই– নিয়ন্ত্রণ এবং ভারসাম্য বৃদ্ধি করে, এমন একটি জীবনধারা গ্রহণ করা: দীর্ঘস্থায়ী চাপ প্রদাহজনক বিদ্রোহের কারণ হতে পারে, কাজেই তা এড়িয়ে চলা বা ম্যানেজ করে চলা; পরিপাকতন্ত্রের সুস্থ মাইক্রোবায়োমকে সমর্থন করার জন্য ফাইবার এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি সুষম খাদ্য বজায় রাখা, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র; পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা, যে সময় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পুনর্নির্মিত হয়; এবং নিয়মিত, পরিমিত ব্যায়াম করা, যা প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন করে আমরা একটি অভ্যন্তরীণ সম্প্রীতি গড়ে তুলতে পারি যেখানে আমাদের প্রতিরক্ষা সর্বদা জাগ্রত, অনুগত এবং চিরকালের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ থাকবে।
