প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১১:১৮
এদিন দেশের সর্বত্র শোকের আবহে নানা কর্মসূচিতে আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ নতুন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার পথে এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়েছে লাখো মানুষের কণ্ঠে। সেই সঙ্গে গোটা জাতি স্বাধীনতার ঊষালগ্নে দেশমাতৃকার মুক্তিসংগ্রামে শাহাদাতবরণকারী জাতির সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
এদিকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের কয়েকজন কর্মী-সমর্থককে এই হামলায় কমপক্ষে ছয় সাংবাদিক আহত হয়েছেন।
রোববার সূর্যোদয়ের ক্ষণে দেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার পাশাপাশি শোকের প্রতীক কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। দেশব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে কালো পতাকা উত্তোলন, শহীদদের স্মৃতির প্রতি পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, স্বেচ্ছায় রক্তদান, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা প্রভৃতি কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়।
রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আলাদাভাবে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। রাষ্ট্রপতি সকাল ৭টা ৪ মিনিটে এবং প্রধান উপদেষ্টা সকাল ৭টা ২২ মিনিটে স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দেন। কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল সামরিক কায়দায় সালাম জানান। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস প্রধান বিচারপতি, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
পরে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যরা ও প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজমের নেতৃত্বে শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং যুদ্ধাহত ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা সকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং পরে রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের আহত ও শহীদদের পরিবারের সদস্যরাও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ফারুক-ই-আজম সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করবে। আগামীর বাংলাদেশ গড়ে উঠবে জুলাই সনদের ভিত্তিতে। অভ্যুত্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনা যেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা সংস্কার করা হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, নারী, ছাত্র, যুব ও শ্রেণি-পেশার সংগঠন ও সর্বস্তরের মানুষ সারিবদ্ধভাবে সেখানে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। একই অবস্থা দেখা গেছে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে।
বিএনপি সকালে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশের কার্যালয়গুলোতে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ করে। পরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে দলটি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে এ সময় উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানসহ অন্য নেতারা।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মির্জা ফখরুল বলেন, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জাতি যখন নতুন করে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে, ঠিক তখনই দেশের শত্রুরা হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছে। এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে দলের নেতারা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পরে তিনি বলেন, নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান নস্যাৎ করতে পরিকল্পিত টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটছে। জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। ১৯৭১, ১৯৪৭ ও ২০২৪ সালের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।
দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানানো শেষে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, স্বাধীনতার সাড়ে পাঁচ দশক পরও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আকাঙ্ক্ষার সাম্যভিত্তিক মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। উল্টো বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার বিপরীতে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। তপশিল ঘোষণার পর নির্বাচন ও গণভোট বানচালের নানা অপতৎপরতা ও নাশকতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল ও জনগণের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, লড়াই এখনও শেষ হয়নি। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ পালিয়ে গেলেও গুপ্তহত্যার চেষ্টা করছে। তারা নির্বাচন বানচাল করতে চাচ্ছে, গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ করতে চাচ্ছে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের আগে দেশকে মেধাশূন্য করতে চক্রান্ত হয়েছে। ঠিক একইভাবে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও দেশকে মেধাশূন্য করার চক্রান্ত চলছে।
শিশু-কিশোর সন্তানদের হাত ধরে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন অনেক বাবা-মাও। এমন একজন অভিভাবক আখতার হোসেন বলেন, শিশুদের মধ্যে যেন মুত্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত হয়। সবকিছু যে রক্তের বিনিময়ে অনেক মূল্য দিয়ে কেনা, সেটা শিশুদের উপলব্ধিতে আনার জন্যই তাদের বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে নিয়ে এসেছি।
মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে আরও শ্রদ্ধা জানিয়েছে গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, সিপিবি, বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, জেএসডি, ন্যাপ, গণফোরাম, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, নাগরিক ঐক্য, বাসদ (মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, আমার বাংলাদেশ (এবি পার্টি), ভাসানী জনশক্তি পার্টি, জাতীয় জনতা পার্টি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয় জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব), জুলাইযোদ্ধা সংসদ, মহিলা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, খেলাঘর, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন। সর্বস্তরের মানুষের অশেষ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অর্ঘ্যে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির মিনারগুলো। জামায়াতে ইসলামী এদিন বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা করেছে।
সাংবাদিকদের ওপর হামলা, আহত ৬
সকাল পৌনে ১০টার দিকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার সময় স্বেচ্ছাসেবক দলের কয়েকজন কর্মী-সমর্থক সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়। এতে অন্তত ছয় সাংবাদিক আহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা জানান, সোহাগ নামের স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন কর্মী সাংবাদিকদের ফুটেজ ধারণে বাধা সৃষ্টি করছিলেন। সাংবাদিকরা সৌজন্যতা বজায় রেখে তাকে একটু সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান। সেই অনুরোধ উপেক্ষা করে শুরু হয় প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার। এক পর্যায়ে সোহাগ ও তার সঙ্গে থাকা উচ্ছৃঙ্খল কর্মীরা ফটো জার্নালিস্ট ডালিমের ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলেন।
এ সময় প্রতিবাদ করতে গেলে অন্য সাংবাদিকদেরও এলোপাতাড়ি মারধর ও কিলঘুসি মারা হয়। এতে দৈনিক যুগান্তরের স্টাফ রিপোর্টার ও মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফখরুল ইসলাম, সময়ের আলোর রিপোর্টার মাহবুব আলম শ্রাবণ, জাগো নিউজের রিপোর্টার রাকিব হাসান, বাংলানিউজ ২৪ ডটকমের রিপোর্টার সাইমুম মুবিন পল্লব, ঢাকা পোস্টের মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার মাহমুদ আল মামুন মারুফ ও জাগো নিউজের ভিডিও জার্নালিস্ট শাহরিয়ার রাকিব আহত হন।
অবশ্য ঘটনার পর স্বেচ্ছাসেবক দলের স্থানীয় নেতা হাফিজ দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চান এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেন।